প্রাকৃতিক উপায়ে ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি

 

প্রাকৃতিক উপায়ে ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি

বর্তমানে আমাদের জীবন ব্যবস্থার ভারসাম্য হারিয়ে গেছে শরীর গঠন বা রোগ না হলে আমরা পরিশ্রম করতে চাইনা খাবার নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বেশ অনীহা পুষ্টিকর খাবারের চেয়ে ফাস্টফুডের দিকে ঝোঁক বেশি। চকলেট, আইসক্রিম,কেক,বিস্কুট,কাচ্চি,বিরিয়ানি চারিদিকে শুধু অস্বাস্থ্যকর চিনি আর চর্বির ছড়াছড়ি।এতো অতিরিক্ত অস্বাস্থ্যকর পুষ্টিবিহীন খাবার শরীর নামক মেশিনের পক্ষে তো প্রসেস করা সম্ভব হচ্ছে না বিধায় নিত্যনতুন অনেক রোগের আবির্ভাব ঘটছে। ডায়াবেটিস সেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটা রোগ। ডায়াবেটিসকে সকল রোগের মা বলা হয়।

ডায়াবেটিস কি???

ইনসুলিনের কার্যপ্রনালী কমে যাওয়া বা না থাকার রক্তে অধিক পরিমাণে চিনি উপস্থিত থাকার অবস্থাকেই ডায়াবেটিস বলে।

ইনসুলিন কি??

ইনসুলিন(insulin) শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ইনসুলা (insula) বা আইল্যান্ড (island) শব্দ থেকে এটি এক ধরনের পেপটাইড হরমোন যা অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষ থেকে উৎপন্ন হয়।এটি শরীরের প্রধান অ্যানাবলিক হরমোন।

ইনসুলিন যেভাবে কাজ করে

ইনসুলিন কার্বোহাইড্রেট, চর্বি এবং প্রোটিনের বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে রক্তে ​​থাকা গ্লুকোজ লিভার, চর্বি এবং কঙ্কালের পেশী কোষে শোষিত করানোর মাধ্যমে এইসব টিস্যুতে শোষিত গ্লুকোজ হয় গ্লাইকোজেনে রূপান্তরিত হয় গ্লাইকোজেনেসিসের মাধ্যমে বা চর্বি (ট্রাইগ্লিসারাইড) তে রূপান্তরিত হয় লাইপোজেনেসিসের মাধ্যমে; আর যকৃতে, গ্লুকোজ উভয়টিতেই রূপান্তরিত হয়।রক্তে অধিক মাত্রায় ইনসুলিনের উপস্থিতির কারণে লিভার দ্বারা গ্লুকোজ উৎপাদন এবং নিঃসরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়। এইকারনে ইনসুলিনকে অ্যানাবলিক হরমোন বলে। কারন এটি রক্তের ছোট অণুকে কোষের বড় অণুতে রূপান্তরিত করে।রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা কমে গেলে উল্টো ঘটনা ঘটে অর্থাৎ রক্তে গ্লুকোজের উপস্থিতি বেড়ে যায়।

পুরো ঘটনার সংক্ষেপ করলে দাড়ায় রক্তে গ্লুকোজ বাড়া কমা টা পুরোপুরি নির্ভর করে ইনসুলিনের উপর। এক‌ইভাবে ডায়াবেটিস হওয়া বা ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি পাওয়াটাও ইনসুলিনের উপর নির্ভর করে।

বিটা কোষ কি???

বিটা কোষ ( β-কোষ ) হল এক বিশেষ ধরনের অন্তঃস্রাবী কোষ যেগুলোকে অগ্ন্যাশয়ে পাওয়া যায়। এই ধরনের কোষগুলো ইনসুলিন এবং অ্যামিলিন উৎপাদন এবং নিঃসরণ করে থাকে

বিটা কোষ যেভাবে ডায়াবেটিস কমায়

ইনসুলিন এবং অ্যামিলিন হরমোন বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রাকে একটি নির্দিষ্ট পরিধির মধ্যে রাখতে সাহায্য করে। কোষ দ্বারা গ্লুকোজ গ্রহণকে সহজতর করে ইনসুলিন এবং খাওয়ার পরে রক্তপ্রবাহে গ্লুকোজ প্রবেশের হার নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে অ্যামিলিন।

সার সংক্ষেপ দাড়ায় ইনসুলিনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিটা কোষ।আমরা বিটা কোষকে সঠিকভাবে উদ্দীপিত করতে পারলে ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি পেতে পারি।

প্রাকৃতিক উপায়ে ডায়াবেটিসকে নিরাময়

কিছু খাবার আছে যা খেলে বিটা কোষকে উদ্দীপিত করে প্রাকৃতিক উপায়ে ডায়াবেটিসকে নিরাময় করা যায়।

সজিনা পাতা

সজনে পাতায় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে, β-কোষের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। মরিঙ্গায় কোয়ারসেটিন, কেম্পফেরল এবং অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মতো যৌগ রয়েছে যা বিটা কোষকে ক্ষতিকারক মুক্ত র‍্যাডিকেলগুলি থেকে নিরপেক্ষ করতে পারে।এতে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান রয়েছে, যা β-কোষকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং প্রদাহ থেকে রক্ষা করতে পারে। ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কমাতে সাহায্য করে।কিছু গবেষণায় β-কোষের পুনরুৎপাদনে সজনে পাতার সম্ভাব্য ভূমিকা দেখা গেছে। 

মেথি

মেথির মধ্যে থাকা বিভিন্ন উপাদান : -হাইড্রোক্সিসোলিউসিন (এই অ্যামিনো অ্যাসিড ইনসুলিন নিঃসরণকে উদ্দীপিত করে।),ট্রাইগোনেলিন ( এই যৌগটি বিটা কোষের কার্যকলাপ বৃদ্ধি করে এবং গ্লুকোজ বিপাককে প্রভাবিত করে।), ডাইওসজেনিন (ইনসুলিন নিঃসরণকে উদ্দীপিত করে এবং প্যানক্রিয়াটিক বিটা কোষের কার্যকারিতা বাড়ায়।)  গবেষণায় দেখা গেছে যে মেথি ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কমাতে এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে। তাছাড়া মেথির অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্য আছে যা বিটা কোষের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে।

গ্ৰীন টি

গ্ৰীন টি তে প্রচুর পরিমানে এপিগ্যালোক্যাটেচিন গ্যালেট (EGCG) পাওয়া যায়। যা একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিটা কোষকে রক্ষা করে এবং ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করে তাই পরিমিত পরিমানে গ্ৰীন টি পান করলে ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।

হলুদ

কারকিউমিন নামক একটি যৌগ হলুদে পাওয়া যায় যা বিটা কোষের কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। কারকিউমিনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্য আছে যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে। কারকিউমিন বিটা কোষকে সাইটোকাইনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে, যা টাইপ এবং টাইপ ডায়াবেটিস হবার জন্য দায়ী।

করলা

করলা কোষের আন্তঃকোষীয় ATP উৎপাদন বৃদ্ধি করে এবং ইনসুলিন-সদৃশ পেপটাইডগুলিকে প্রভাবিত করে।এটি ইনসুলিন উৎপাদনকারী β কোষের পুনর্জন্মকে উৎসাহিত করতে পারে।

অ্যালোভেরা

অ্যালোভেরার নির্যাস ইনসুলিন নিঃসরণ বাড়াতে সাহায্য করে।ইনসুলিনের প্রতি শরীরের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে, কোষগুলিকে গ্লুকোজ গ্রহণের জন্য আরও গ্রহণযোগ্য করে তোলে।অ্যালোভেরার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্যগুলি ফ্রি র‍্যাডিকেলগুলিকে নিরপেক্ষ করতে এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে, যা বিটা কোষের ক্ষতি এবং কর্মহীনতার জন্য অবদান রাখে বলে জানা যায়।

পেঁয়াজের নির্যাস

মার্কিন গবেষণায় দেখা গেছে, পেঁয়াজের নির্যাসে উপস্থিত অ্যালিয়াম সিপা মেটফরমিনের মতো প্রাকৃতিক বিটা কোষ উদ্দীপক উপাদান ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। পেঁয়াজকে বলা হয় ডায়াবেটিসের নিরাময়ের সস্তা এবং সহজলভ্য উপাদান।

লবঙ্গ

লবঙ্গে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং প্রদাহ-বিরোধী বৈশিষ্ট্যযুক্ত বিভিন্ন যৌগ রয়েছে, যেমন ইউজিনল।  এই বৈশিষ্ট্যগুলি বিটা কোষগুলিকে জারণ চাপ এবং প্রদাহ থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করতে পারে, যা বিটা কোষের ক্ষতি এবং কর্মহীনতার জন্য অবদান রাখে বলে জানা যায়।  ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ (NIH) এর একটি গবেষণা অনুসারে দেখা গেছে, ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে, লবঙ্গের নির্যাস সপ্তাহের জন্য দৈনিক ১০০ মিলিগ্রাম/কেজি পরিমাণে প্রয়োগ করলে, রক্তে শর্করার মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায় (৩৩%) এবং ইনসুলিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায় (৭৪%) গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, লবঙ্গের নির্যাস অগ্ন্যাশয়ের ক্ষতিগ্রস্ত β-কোষকে মেরামতে সাহায্য করে।

দারুচিনি

দারুচিনি যেমন :- সিলন দারুচিনি (Cinnamomum zeylanicum) ডায়াবেটিস কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।দারুচিনি ইনসুলিন সিগন্যালিং পথগুলিকে সক্রিয় করে, যেমন :- ইনসুলিন রিসেপ্টর এবং IRS1/PI3K , যার ফলে গ্লুকোজ গ্রহণ বৃদ্ধি পায়।দারুচিনির অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যৌগগুলি বিটা কোষকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচায়।এর প্রদাহ-বিরোধী বৈশিষ্ট্য বিটা কোষকে প্রদাহজনিত ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। দারুচিনির গুঁড়া চা, পানি বা অন্য পানীয়ের সঙ্গে মিশিয়ে পান করা যেতে পারে

বাঁধাকপি

বাধাকপিতে উপস্থিত গ্লুকোসিনোলেটস (glucosinolates) নামক উপাদান ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করে এবং গবেষণায় দেখা গেছে যে, এটি ইনসুলিন নিঃসরণেও সাহায্য করে।বাধাকপি ভিটামিন, মিনারেল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ, যা পরোক্ষভাবে বিটা কোষের কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখে।লাল বাঁধাকপিতে উপস্থিত প্রাকৃতিক লাল রঞ্জক, বিটালাইন, রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে এবং ইনসুলিন উৎপাদন বাড়ায়।

তোকমা বা চিয়া বীজ

চিয়া বীজ ফাইবার এবং ওমেগা- ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ, যা ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করতে, প্রদাহ কমাতে সাহায্য করতে পারে। বীজের দ্রবণীয় ফাইবার রক্তে শর্করার শোষণ কমাতে সাহায্য করে, যার ফলে বিটা কোষের উপর চাপ কম পড়ে।  চিয়া বীজে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যেমন কোয়ারসেটিন, যা ক্ষতিকারক ফ্রি র‍্যাডিকেলগুলিকে নিরপেক্ষ করতে সাহায্য করে।চিয়া বীজ ম্যাগনেসিয়ামেরও একটি ভালো উৎস, যা ইনসুলিন নিঃসরণ এবং গ্লুকোজ বিপাকের সাথে জড়িত।

আদা

আদাতে পাওয়া জিঞ্জেরল এবং শোগাওল, যৌগগুলি 5-HT3 রিসেপ্টরের সাথে মিথস্ক্রিয়া করতে দেখা গেছে, যা সম্ভাব্যভাবে বিটা কোষের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে।আদার নির্যাস অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষের পুনর্জন্মকে উৎসাহিত করে। এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য বিটা কোষকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে, অন্যদিকে এর প্রদাহ-বিরোধী প্রভাব অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ কমাতে পারে, যা বিটা কোষের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। 

রসুন

রসুনের নির্যাস ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে NF-κB/TLR-4 এবং SERCA/Ca2+ পথগুলিকে মডিউল করে বিটা কোষের কার্যকারিতা সংরক্ষণ করে ।রসুনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমিয়ে বিটা কোষের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে।

ঢেঁড়স

ঢেঁড়সে কোয়ারসেটিনের মতো যৌগ থাকে, যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে।  এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষগুলিকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।কিছু গবেষণায় দেখা গেছে , ঢেঁড়সের বীজ এবং খোসাতে কিছু বায়োঅ্যাক্টিভ উপাদান রয়েছে যা বিটা কোষের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে, তবে এই বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন।

মাশরুম

কিছু মাশরুম প্রজাতি, যেমন shiitake(অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষ রক্ষা করে, ইনসুলিন উৎপাদন বাড়ায় এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে),Oyster (বিটা-গ্লুকান রয়েছে যা ডায়াবেটিসের কার্যকারিতা বাড়ায়), Maitake ( বিটা-গ্লুকান রয়েছে এবং রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণ করে),Ganoderma (Reishi) (অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে), Cordyceps (উপস্থিত β-গ্লুকান বিটা কোষের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে।)বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, মাশরুমের বায়োঅ্যাকটিভ উপাদানগুলি অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস (oxidative stress) এবং গ্লুকোটক্সিসিটি (glucotoxicity) থেকে রক্ষা করে। এর ফলে বিটা কোষের কার্যকারিতা বাড়ে এবং ইনসুলিন নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়। 

Next Post
No Comment
Add Comment
comment url