হিট স্ট্রোক কী, কেন হয় ও প্রতিরোধের ঘরোয়া উপায়
হিট স্ট্রোক কী, কেন হয় ও প্রতিরোধের ঘরোয়া উপায়
ভূমিকা
দেশব্যাপী চলমান তীব্র গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন।রেকর্ড ছোঁয়া তাপমাত্রায় দেশবাসীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।চিকিৎসকরা বলছেন, এরকম তীব্র গরমের সময় সতর্ক না থাকলে হিট স্ট্রোকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। গ্ৰামের পুরুষদের মধ্যে হিট স্ট্রোকে মৃত্যু হার সবচেয়ে বেশি।বিশেষ করে যারা প্রচন্ড গরমে খোলা আকাশের নীচে চলাফেরা করে বা শারীরিক পরিশ্রম করে।এমন পরিস্থিতিতে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
কি
চিকিৎসা শাস্ত্র অনুযায়ী,আমাদের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা হচ্ছে ৩৭-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৯৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট।যখন শরীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেলে ঘাম বন্ধ হয়ে যায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে যায়, তাকে হিট স্ট্রোক বলে।
কেন হয়
আমাদের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস শরীরের তাপমাত্রা ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখতে সাহায্য করে।শরীরের তাপমাত্রার পরিবর্তন হলে হাইপোথ্যালামাস কিছু জায়গায় সিগনাল পাঠিয়ে সাম্যাবস্থা আনে।যেমন তাপমাত্রা বেড়ে গেলে হাইপোথ্যালামাস ঘর্ম গ্ৰন্থিতে সিগনাল পাঠাই ঘাম নিসৃত করার জন্য যা বাষ্পীভবনের মাধ্যমে শরীর ঠান্ডা করে।হাইপোথ্যালামাস ত্বকে রক্তের প্রবাহ নিয়ন্ত্রন করেও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করে।রক্তনালী প্রসারিত করে অতিরিক্ত তাপ বের করে দেয়।কিন্তু দীর্ঘ ক্ষন তাপদাহের মধ্যে থাকলে অতিরিক্ত তাপ বের করা হাইপোথ্যালামাসের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায় তখন হিট স্ট্রোক ঘটে।
প্রকারভেদ
হিট স্ট্রোক প্রধানত দুই ধরনের:
ক্লাসিক হিট স্ট্রোক
পরিবেশগত কারণ যেমন- দীর্ঘক্ষণ গরম আবহাওয়ায় থাকার কারণে হয়ে থাকে।
এক্সারশনাল হিট স্ট্রোক
শারীরিক কারণ যেমন - অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করার কারণে হয়ে থাকে।
লক্ষন
- তাপমাত্রা দ্রুত ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায়।
- প্রাথমিকভাবে শরীরের মাংসপেশী ব্যথা করে, দুর্বল লাগে এবং প্রচন্ড পিপাসা হয়।
- শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়
- নাড়ির স্পন্দন ক্ষীণ কিন্তু দ্রুত হয়
- রক্তচাপ কমে যায় ও হৃৎস্পন্দন হঠাৎ বেড়ে যায়
- মাথা ব্যথা করে, ঝিম ঝিম করে এবং ঘোরায়
- প্রচুর ঘাম হয়
- খিঁচুনি হয়
- বমি বমি ভাব হয় ও বমি হয়
- প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়, গাঢ় রঙের প্রস্রাব হয়,প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হয়,
- ত্বক শুষ্ক, খসখসে ও চামড়া ফ্যাকাশে দেখায়
- মানসিক অবস্থার হঠাৎ পরিবর্তন আসে, কথা জড়িয়ে যায়,বিরক্তিভাব আসে, প্রলাপ বকে,অসংলগ্ন আচরণ করে,মতিভ্রম (হেলুসিনেশন) হয়
- গরম আবহাওয়ার কারণে হলে ত্বক অত্যন্ত গরম এবং শুষ্ক অনুভূত হয়।
- অতিরিক্ত ব্যায়ামের কারণে হলে ত্বক সামান্য আর্দ্র বোধ হয়।
- তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে ত্বক লালচে হয়ে যায়।
- চোখে ঝাপসা দেখে, হাঁটতে কষ্ট লাগে
- শেষের দিকে ঘাম বন্ধ হয়ে যায়
- নিস্তেজ হয়ে পড়ে ও জ্ঞান হারিয়ে যায়
কারা বেশি ঝুকিতে??
- বৃদ্ধ ও শিশুরা
- প্রতিবন্ধী ব্যক্তি
- শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিলে
- স্থুলকায় ব্যক্তিরা
- যারা দিনের বেলায় প্রচণ্ড রোদে শারীরিক পরিশ্রম করে। যেমন- কৃষক, শ্রমিক, রিকশাচালক,দালাল
- যারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার বা হার্ট, স্ট্রোক বা ক্যান্সারজনিত রোগ
- যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম
- কিছু কিছু ওষুধ গ্ৰহনকারী যেমন- প্রস্রাব বাড়ানোর ওষুধ, বিষণ্ণতার ওষুধ,BP ওষুধ, অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট
প্রতিরোধের ঘরোয়া উপায়
- তীব্র গরম থেকে দূরে থাকা, যতবেশি সম্ভব ছায়ায় বিশ্রাম নেয়া।
- ঢিলেঢালা, পাতলা,সাদা অথবা হালকা রঙের পোশাক পরা, গাঢ় রঙিন পোশাক এড়িয়ে চলা, সুতি কাপড় পরা
- প্রচুর পরিমাণে নিরাপদ পানি পান করা। প্রাণঘাতি পানিবাহিত রোগ থেকে বাঁচার জন্য রাস্তায় তৈরি পানীয় ও খাবার এড়িয়ে চলা। গরমে ঘামের সঙ্গে পানি ও লবণ বের হয়ে যায়। তাই পানির সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার স্যালাইন, ফলের রস পান করতে হবে।
- প্রয়োজনে একাধিকবার ঠান্ডা পানিতে গোসল করা।
- শিশুদের ও বয়স্কদের বাসা থেকে কম বের করা।
- বাসার পরিবেশ গরম যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা। সম্ভব হলে ফ্যান, এয়ার কুলার, এসি ব্যবস্থা করা।
- বাসা থেকে বের হবার সময় ছাতা, সানগ্লাস ও খাবার পানি সঙ্গে রাখা।
- প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হওয়া। বিশেষত দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৩ টা পর্যন্ত।সূর্য মুখী জানালার পর্দা টেনে দেয়া।
- অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমের কাজ এড়িয়ে চলা,সম্ভব না হলে ঘনঘন বিরতি নেয়া এবং বিশ্রামের জন্য শীতল জায়গা খোঁজা।
- পানিশূন্য করতে সাহায্য করে এমন পানীয় পরিহার করা যেমন - চা, কফি,অ্যালকোহল
- বাইরে গেলে সানস্ক্রিন ব্যবহার করা।
- লম্বা বারান্দার টুপি পরা।
- দিনের বেলায় ব্যায়াম পরিহার করা।একান্তই প্রয়োজন পড়লে ঠান্ডা পানিতে সাঁতার কাটা। নিয়মিত করা ব্যায়ামটা ভোর ৪ টি থেকে ৬টার মধ্যে সম্পূর্ণ করা।
- প্রস্রাবের রঙ হলুদ হলে পানি খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া
- অসুস্থবোধ হলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধক খাবার
- কাচা আমের রস - ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার ।যা রোগ প্রতিরোধ করে ও শরীরের তাপ কমাতে সাহায্য করে।
- ডাবের পানি - সোডিয়াম,পটাসিয়াম আয়ন সমৃদ্ধ পানীয়।পিপাসা মেটায় ও হিট স্ট্রোক প্রতিরোধ করে।
- অ্যালোভেরার শরবত
- পুদিনার শরবত
- তেতুলের শরবত
- সালাদ, শসা
- মৌসুমী ফল - তরমুজ
- দুগ্ধজাতীয় খাবার - দই, মাঠা, ঘোল,লাচ্চি
প্রাথমিক চিকিৎসা
- রোগীকে দ্রুত শীতল স্থানে নিয়ে যেতে হবে। ফ্যান/এসি ছেড়ে দিতে হবে।
- পরিধেয় কাপড় ঢিলে করে দিতে হবে
- শুয়ে দিতে হবে এবং পা সামান্য উপরে তুলে ধরতে হবে।
- ঠান্ডা পানি বা বরফ দিয়ে গোসলের ব্যবস্থা করতে হবে।
- গোসল সম্ভব না হলে ভেজা কাপড় দিয়ে পুরো শরীর মুছে দিতে হবে।
- ত্বকের ওপর ঠান্ডা ভেজা কাপড় বা স্পন্জ রাখতে হবে।
- রোগীর আশেপাশে ভিড় করা যাবে না পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে।
- কাঁধে, বগলে ও কুচকিতে বরফ দিতে হবে।
- রোগীর জ্ঞান থাকলে খাবার স্যালাইন খাইয়ে দিতে হবে ।
- দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
- প্রয়োজনে সিপিআর বা কৃত্রিমভাবে শ্বাস প্রশ্বাস দিতে হবে।
পরিসংখ্যান
২০০০-২০০৪ থেকে ২০১৭-২০২১ সালের মধ্যে ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের তাপজনিত মৃত্যুহার প্রায় ৮৫% বৃদ্ধি পেয়েছে ।২০০০-২০১৯ সালের মধ্যে গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রতি বছর প্রায় ৪৮৯,০০০ জনের তাপজনিত মৃত্যু ঘটে, যার মধ্যে ৪৫% এশিয়ায় এবং ৩৬% ইউরোপে। ২০২২ সালের গ্রীষ্মে শুধুমাত্র ইউরোপে আনুমানিক ৬১,৬৭২ জনের তাপজনিত অতিরিক্ত মৃত্যু ঘটেছিল। উচ্চ তীব্রতার তাপপ্রবাহ উচ্চ মৃত্যুহার ডেকে আনে; ২০০৩ সালে, জুন-আগস্টের ঘটনার ফলে ইউরোপে ৭০,০০০ জন মানুষ মারা গিয়েছিল। ২০১০ সালে, রাশিয়ান ফেডারেশনে ৪৪ দিনের তাপপ্রবাহে ৫৬,০০০ জনের অতিরিক্ত মৃত্যু ঘটেছিল।