কোষ্ঠ্যকাঠিন্য: কারণ, উপসর্গ এবং ঘরোয়া প্রতিকার

কোষ্ঠ্যকাঠিন্য: কারণ, উপসর্গ এবং ঘরোয়া প্রতিকার

কোষ্ঠ্যকাঠিন্য কি,কেন ও ঘরোয়া চিকিৎসা

ভূমিকা

কোষ্ঠ্যকাঠিন্য একটি নীরব সমস্যা যা দৈনন্দিন জীবনে অস্বস্তি তৈরি করে। এটি শুধু শারীরিক কষ্টই নয়, মানসিক চাপেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়।কোষ্ঠ্যকাঠিন্য আসলে আমাদের শরীরের এক ধরনের সতর্কবার্তা।আজকের ব্যস্ত জীবনে অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, কম পানি পান শারীরিক পরিশ্রমের অভাবে কোষ্ঠ্যকাঠিন্য প্রকট হয়ে দাঁড়াচ্ছে।প্রথম দিকে হালকা মনে হলেও কোষ্ঠ্যকাঠিন্য দীর্ঘদিন অবহেলা করলে দেখা দিতে পারে নানা জটিলতা।কোষ্ঠ্যকাঠিন্য থেকে মুক্তি পেতে কীভাবে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে সমাধান মিলতে পারে, তা নিয়েই এই আলোচনা।

কি

কোষ্ঠকাঠিন্য একটি লক্ষণ, রোগ নয়।চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, সপ্তাহে বারের কম মলত্যাগ ওয়াকে কোষ্ঠকাঠিন্য বলে। তবে,সাধারণ মানুষ শক্ত বা শুষ্ক মলত্যাগ করাকে কোষ্ঠকাঠিন্য বলে থাকে।

স্বাভাবিকতা

প্রাপ্তবয়স্কদের মলত্যাগের স্বাভাবিকতা হচ্ছে প্রতিদিন তিন বার থেকে সপ্তাহে তিন বার।।  শিশুদের দিনে তিন থেকে চার বার মলত্যাগ হয়, যেখানে ছোট বাচ্চাদের সাধারণত দিনে দুই থেকে তিন বার মলত্যাগ হয়।

উপসর্গ

কোষ্ঠকাঠিন্যের উপসর্গ গুলির মধ্যে রয়েছে:
  • সপ্তাহে তিনবারের কম মলত্যাগ করা
  • মল শক্ত শুকনো ওয়া।
  • মলত্যাগের সময় টান বা ব্যথা অনুভব ওয়া।
  • সমস্ত মলত্যাগ হয়নি এমন অনুভূতি ওয়া
  • মলদ্বারে মল আটকে আছে বলে মনে ওয়া।
  • মলত্যাগের জন্য আঙুল ব্যবহার করার প্রয়োজন পরা।
  • মলত্যাগের জন্য জোর দিতে প্রয়োজন পরা।
  • পেট ফুলে ওঠা এবং শক্ত মনে হওয়া
  • পেটে ব্যথা বা খিঁচুনি
  • প্রচুর গ্যাস বের হওয়া বা ঘন ঘন ঢেকুর তোলা
  • বমি বা বমি বমি ভাব
  • অল্প পরিমাণে তরল মল  যা ডায়রিয়ার মতো বের ওয়া

কারন

  • পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান না করা।
  • পর্যাপ্ত পরিমাণে আঁশযুক্ত খাবার না খাওয়া
  • নিয়মিত ব্যায়াম না করা বা যথেষ্ট পরিমাণে পরিশ্রম না করা।
  • মলত্যাগের বেগ পাওয়ার পর যথাসময়ে টয়লেটে না যাওয়া
  • কিছু রোগের জন্য হতে পারে :- ব্যথা,উচ্চ রক্তচাপ,খিঁচুনি, বিষণ্ণতা, স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা, অ্যালার্জি।
  • পেলভিক ফ্লোর পেশীগুলির দুর্বলতা বা সমন্বয়ের সমস্যার জন্য।
  • কোলন বা মলদ্বারে টিস্যুতে ক্ষতি বা পরিবর্তন  বা কাছাকাছি টিস্যুতে টিউমার মলত্যাগে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
  • কিছু রোগ পেশী, স্নায়ু বা মলত্যাগের সাথে জড়িত হরমোনের কাজকে প্রভাবিত করতে পারে। যার মধ্যে রয়েছে: ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম, ডায়াবেটিস, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস, স্নায়ুর কর্মহীনতা বা ক্ষতিহাইপারথাইরয়েডিজম, পার্কিনসন রোগ, গর্ভাবস্থা।
কখনও কখনও, দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্যের কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।

ওষুধ

কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণ হতে পারে এমন সাধারণ ওষুধ গুলির মধ্যে রয়েছে:
  • অ্যালুমিনিয়াম অ্যান্টাসিড (বদহজমের চিকিৎসার জন্য ওষুধ)
  • অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস
  • অ্যান্টিএপিলেপটিকস (মৃগীরোগের চিকিৎসার জন্য ওষুধ)
  • অ্যান্টিসাইকোটিকস (সিজোফ্রেনিয়া এবং অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থার চিকিৎসার জন্য ওষুধ)
  • ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট
  • ওপিয়েড ব্যথানাশক, যেমন কোডিন এবং মরফিন
  • ডায়ইউরেটিকস
  •  আয়রন সাপ্লিমেন্ট

কারা বেশি ঝুকিতে

  • বয়স্ক
  • মহিলা (গর্ভাবস্থা অথবা বাচ্চা ভুমিষ্ঠ হবার পর)
  • অলসরা
  • মানসিক বিকার গ্ৰস্থ বা বিষন্নতায় ভোগারা
  • যারা অনিয়মিত খাবার খায় এবং ফাইবার জাতীয় খাবার খায় না বা অল্প খায়।
ঘরোয়া চিকিৎসা

ঘরোয়া প্রতিকার

ফাইবার জাতীয় খাবার

প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে ফাইবার জাতীয় খাবার খাওয়া ।ফাইবার অনেক ধরনের হয়ে থাকে তবে দ্রবণীয়তার ভিত্তিতে ভাগে ভাগ করা হয়।

  • অদ্রবণীয় ফাইবার - গমের তুষ, শাকসবজি এবং পুরো শস্যে উপস্থিত - মলগুলোর ঘনত্ব বাড়িয়ে পরিপাকতন্ত্রের মাধ্যমে দ্রুত এবং সহজে যেতে সাহায্য করে।
  • দ্রবণীয় ফাইবার - ওট ব্রান, বার্লি, বাদাম, বীজ, মটরশুটি, মসুর ডাল এবং মটর, সেইসাথে কিছু ফল এবং শাকসবজিতে উপস্থিত থাকে - জল শোষণ করে এবং একটি জেলীর মতো পেস্ট তৈরি করে, যা মলকে নরম করে।

পানি পান

প্রচুর পানি পান করা তরল জাতীয় খাবার খাওয়া

নিয়মিত ব্যায়াম

প্রতিদিন নিয়মিত ব্যায়াম করা। প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি সপ্তাহে ১৫০ মিনিট ( ঘন্টা ৩০ মিনিট) মাঝারি তীব্রতার ব্যায়াম করা উচিত।

সময় দেয়া

মলত্যাগের জন্য যথেষ্ট সময় দেয়া তাড়াতাড়ি না করা

দেরি না করা

মলত্যাগের বেগ অনুভব করলে দেরি না করা।

একই সময়ে

 প্রতিদিন একই সময়ে মলত্যাগ করার চেষ্টা করা

রোগ বা অবস্থা

কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা তৈরি করতে পারে এমন কোন রোগ বা অবস্থা থাকলে তার সমাধান করা।

কফি পান

মাঝে মধ্যে কফি পান করা ।কারণ কফি অন্ত্রের পেশীগুলিকে উদ্দীপিত করে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। এতে অল্প পরিমাণে দ্রবণীয় ফাইবার থাকে।

প্রোবায়োটিক

প্রোবায়োটিক হল জীবন্ত, উপকারী ব্যাকটেরিয়া যা প্রাকৃতিকভাবে অন্ত্রে পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে বাইফিডোব্যাকটেরিয়া এবং ল্যাকটোব্যাসিলাস।প্রোবায়োটিক খাবারের মধ্যে রয়েছে:দই, কিমচি।প্রোবায়োটিক দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ে সাহায্য করে। তাই নিয়মিত প্রোবায়োটিক খাবার খাওয়ার চেষ্টা করা।

প্রিবায়োটিক

প্রিবায়োটিক ফাইবারযুক্ত খাবার হজমের স্বাস্থ্য এবং অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য রক্ষা করে। প্রিবায়োটিক কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।প্রিবায়োটিক খাবারের মধ্যে রয়েছে: কলা, ছোলা।

আলুবোখারা

আলুবোখারায় চিনির অ্যালকোহল সরবিটল থাকে, যার রেচক বা ল্যাক্সেটিভ প্রভাব রয়েছে। আলুবোখারা কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য খুব কার্যকর প্রতিকার হতে পারে।

ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা

যাদের ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা আছে ।তাদের কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণ হতে পারে। তাই খাদ্যতালিকা থেকে দুগ্ধজাত খাবার বাদ দিলে লক্ষণগুলি উপশম হবে।

তিসির বীজ

তিসির বীজ হল একটি ছোট বীজ যা তিসি গাছ থেকে আসে এবং এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে। বিশেষ করে, তিসির বীজে এক ধরণের ফাইবার থাকে যাকে মিউসিলেজ ফাইবার বলা হয়। এই ধরণের ফাইবার পানির সাথে মিশে জেল তৈরি করে, যা মল নরম করতে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে প্রাকৃতিক রেচক হিসেবে কাজ করে।

জটিলতা

দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্যের কারনে নিম্নলিখিত  জটিলতাগুলি ঘটতে দেখা যায় :
  •  মলদ্বারের চারপাশে টিস্যু ফুলে যাওয়া, যাকে অর্শ বলে।
  • মলদ্বারের টিস্যু ছিঁড়ে যাওয়া , যাকে মলদ্বারের ফিসার বলে।
  • শক্ত মল কোলনে ফিরে যাওয়া, যাকে মলের আঘাত বা ইমপেকশন বলে।
  • মলদ্বারের বাইরে টিস্যু পিন্ড বের হয়ে আসা, যাকে মলদ্বার প্রল্যাপস বলে।
  • দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠ্যকাঠিন্যের জন্য পেলভিক মাসল দুর্বল হয়ে পড়ে যার ফলে অনিচ্ছাকৃতভাবে হাসি,হাঁচি,কাশির সময় প্রস্রাব বের হয়, যাকে মূত্রথলির অসংযম বা ইনকন্টিনেন্স বলে।

কখন ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত

  • লক্ষণ তিন সপ্তাহের বেশি সময় স্থায়ী লে
  • দৈনন্দিন কাজকর্ম বাধাগ্ৰস্থ হলে।
  • মলদ্বারে রক্ত দেখা দিলে।
  • মলের সাথে রক্ত আসলে ​​বা কালো মল আসলে
  • মলের আকার বা রঙের পরিবর্তন হলে।
  • পেটে অসহ্য ব্যথা হলে
  •  কোন রকম চেষ্টা ছাড়াই ওজন কমা শুরু হলে।

উপসংহার

অন্ত্র ভালো থাকলে মন শরীর দুটোই ভালো থাকে।দীর্ঘদিনের কোষ্ঠ্যকাঠিন্য বড় রোগের দিকে যেতে পারে।কোষ্ঠ্যকাঠিন্যকে অবহেলা করবেন না। কারণ এটি আপনার শরীরের গুরুত্বপূর্ণ সংকেত।কোষ্ঠ্যকাঠিন্য দূর করা কঠিন কিছু নয়।দৈনন্দিন জীবনে কিছু ছোট খাটো অভ্যাসের পরিবর্তনই কোষ্ঠ্যকাঠিন্য থেকে মুক্তির চাবিকাঠি হতে পারে। শুরুতেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন। সঠিক খাবার, পর্যাপ্ত পানি এবং নিয়মিত ব্যায়ামেই মেলে স্থায়ী সমাধান।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url