ওজন কমানোর ১৬ টি সহজ উপায়

ওজন কমানোর ১৬ টি সহজ উপায়

ওজন কমানোর ১৬ টি সহজ উপায়

বর্তমানের প্রযুক্তিনির্ভর জীবনে কম চলাফেরা অনিয়ন্ত্রিত, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে ওজন বৃদ্ধি একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওজন কমানো মানেই উপোস থাকা নয়,বরং এটা একটি নিয়মতান্ত্রিক জীবন ব্যবস্থার অংশ। ওজন কমানোর মাধ্যমে মানুষ শুধুমাত্র পাতলা হয় না,বরং আত্মবিশ্বাস বাড়ে, ক্লান্তি কমে, জীবনে নতুন উদ্যম আসে। দ্রুত ফল পেতে অনেকে শর্টকাট পথ বেছে নেয়। কিন্তু এগুলো  দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়।

ওজন কমানো

ওজন কমানো বলতে উচ্চতা অনুসারে স্বাভাবিক ওজন বজায় রাখা। স্বাভাবিকের চেয়ে ওজন বেশি থাকলে বাড়তি ওজন টা কমানো। ওজন কমানো বলতে কখনোই  স্বাভাবিকের চেয়ে ওজন বেশি পরিমাণে কমানো বুঝায় না। এজন্য বিএমআই (BMI) ক্যালকুলেটরের সহায়তা নিয়ে নিজের ওজন স্বাভাবিক কতো তা আগে জেনে নেয়া উচিত।

নিচে ওজন কমানোর ১৬ টি সহজ উপায় দেয়া হল :-

মানসিক চাপ কমানো

মানসিক চাপ শরীরের উপর অনেক প্রভাব ফেলে। দুশ্চিন্তা,উদ্বিগ্নার মধ্যে সব সময় থাকলে শরীর এক ধরনের হরমোন নিঃসরন করে যা রক্তের গ্লুকোজের মাত্রার উপর প্রভাব ফেলে। শরীরের ওজন বাড়িয়ে দেয়।এতে আপনার ওজন কমানোর চেষ্টা বৃথা করে ফেলে। তাই প্রথমে মানসিক প্রশান্তি আনা দরকার তারপর অন্য চেষ্টা করা উচিত। মানসিক চাপ কমালে ওজন কমতে সহায়তা করে।

পানি পান করা

সময় পেলেই পানি পান করুন। হাতের কাছেই পানি রাখুন।পানি আনতে যেনো অলসতা কাজ না করে।একজন স্বাভাবিক মানুষের দৈনিক - লিটার বা -১২ গ্লাস পানি খাওয়া উচিত। চা,কফি,খাবার, নাস্তা যাই করুন শুরু করার পুর্বে যতটা সম্ভব পানি পান করুন। এতে পেট ভরা থাকবে। মনে রাখবেন মানব শরীরের ৫০-৭৫% পানি দ্বারা গঠিত তাই পানি চাহিদা মাফিক খেলে শরীর সতেজ থাকবে, ক্ষুধা কম লাগবে। খাবারের আগে পরে যখন সুযোগ হবে পানি পান করুন। খাবার ছাড়া মানুষ কয়েক সপ্তাহ বেঁচে থাকতে পারে কিন্তু পানি ছাড়া বেশি দিন বাঁচতে পারে না। তাই বেশি বেশি পানি করে ওজন কমানোর পথে এগিয়ে যান।

খাবারে প্রোটিন রাখা

সাধারণ কার্বোহাইড্রেট সহজে ভেঙে গিয়ে গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু  প্রোটিন ভেঙে গ্লুকোজে পরিণত হতে অনেক সময় লাগে মানে পেট অনেক ক্ষণ ধরে ভরা থাকে ক্ষুধা কম লাগে। যার ফলে শরীরের ওজন কম হবে। তাই সাধারণ কার্বোহাইড্রেটে খাবার প্লেট না সাজিয়ে একটা বড় অংশে প্রোটিন রাখুন। প্রোটিন শরীর গঠনেও সাহায্য করে।

  • সাধারণ কার্বোহাইড্রেট : সাদা আটা, রুটি,ভাত।
  • প্রোটিন : ডিম, মাংস, দুগ্ধজাত পণ্য, বাদাম এবং ডাল।

কিন্তু অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে হবে। বেশি খাওয়া যাবে না। এতে শরীরের অন্যান্য ক্ষতি হতে পারে।

খাবার একেবারে না খাওয়া

খাবার না খেলে ওজন কমে যাবে আমরা এমনটাই ভাবি। তাই যারা খুব দ্রুত ওজন কমাতে চাই তারা প্রথমেই এই চেষ্টাটা করে থাকি। কিন্তু এটা কখনোই ভালো সিদ্ধান্ত না। এই ব্যাপার টা এমন দাঁড়ায় যে ১০ তলার উপর থেকে সিঁড়ি বা লিফট ব্যবহার করে না নেমে সরাসরি লাফ দিয়ে দ্রুত নামা। যা কখনোই ভালো ফলাফল দেয় না। শুধু ক্ষতিই ডেকে আনে।আমাদের একবারেই খাবার বাদ না দিয়ে ধীরে ধীরে কমানো উচিত। অবশ্যই খাবারে পুষ্টির সাম্যাবস্থা রাখা উচিত। হঠাৎ করে বন্ধ করে শরীরের পক্ষে সব কার্যকলাপ চালু রাখা সম্ভব হয় না।

রাতের খাবার সকালের নাস্তার সময়

রাতের খাবার সকালের নাস্তার মধ্যে সময় ব্যবধান যতবেশি সম্ভব বাড়ানো উচিত। তবে হঠাৎ করে নয় ধীরে ধীরে। রাতের খাবারের সময় আগানো সকালের নাস্তার সময় ধীরে ধীরে পেছানো উচিত। এই ব্যবধান টা যতবেশি রাখা যাবে ততবেশি শরীর থেকে চর্বি কেটে যাবে। ফলে শরীরের ওজন কমে যাবে।

ফাইবার জাতীয় খাবার

ফাইবার জাতীয় খাবার যেমন :- ফল, শাকসবজি, আস্ত শস্য, মসুর ডালসহ আরো অনেক খাবার প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। ফাইবার জাতীয় খাবার সহজে হজম হয় না। এর হজম হতে অনেক সময় লাগে ফলে পেট অনেক ক্ষণ ভরা থাকে। ফলে অল্প খাবারেই বেশি খাবারের কাজ করে থাকে এবং ওজন কমে যায়।

খাবার চিবিয়ে খাওয়া

খাবার পাকস্থলীতে পাঠানোর পুর্বে ভালো করে চিবিয়ে না পাঠালে, পাকস্থলীর সেই খাবারটি পুরোটা ভাঙতে পারে না। যার ফলে পাকস্থলীতে অযাচিত গ্যাসের সৃষ্টি হয়। পেট ফেঁপে যায়। খাবার ভালভাবে না ভাঙলে পুষ্টি শোষিত হতে পারে না। ফলে ক্ষুধা লেগে থাকে আরো বেশি খাওয়া লাগে। তাই খাবার খাওয়ার সময় ভালোভাবে চিবিয়ে খাওয়া উচিত। খাবার মুখে ঠিক ভাবে চাবাইলে খাবারের সাথে মুখের লালা মিশে যায়। লালাতে থাকা টায়ালিন খাবারকে ভেঙে শোষণ উপযোগি হয়ে যায়। খাবার ঠিক ভাবে শোষণ হলে আর ক্ষুধা লাগে না। ফলে অল্প পরিমাণ খাবারেই শরীরের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। শরীরের ওজন স্বাভাবিক হয়ে যায়।

মনোযোগ দিয়ে খাওয়া

খাবার খাওয়ার সময় অবশ্যই মনোযোগ দিয়ে খাবার খাওয়া উচিত কারণ মস্তিষ্ক এক সাথে কয়েক দিকে মনোযোগ দিতে পারে না। খাবার সময় সিনেমা,নাটক দেখলে মস্তিষ্ক সঠিক সংকেত তৈরি করতে পারে না। মস্তিষ্কের কি, দেখার জন্য সংকেত পাঠাবে না খাওয়ার জন্য তা বুঝতে পারে না। কারণ চোখ দিয়ে দেখা মানে শুধু দেখা নয় এর সাথে অনুভূতি জড়িয়ে আছে দুঃখ,কষ্ট,আনন্দ। মস্তিষ্ক এসব অনুভূতি তৈরিতে সময় দেওয়ার জন্য খাবারের দিকে মনোযোগ দিতে পারে না যার ফলে খাবারের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করতে পারে না। ফলে খাবার ঠিক মতো শোষণ হতে পারে না। পেটে ক্ষুধা লেগে থাকে বার বার খাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। তাই খাবার সময় মনোযোগ দিয়ে শুধু খাবার খেলে ওজন কমে শরীর স্বাভাবিক অবস্থায় আসে।

ওজন কমানোর উপায়

সিঁড়ি ব্যবহার

হাতে সময় থাকলে লিফট ব্যবহার না করে সিঁড়ি ব্যবহার করুন। একজন ১৭৫ পাউন্ড ওজনের মানুষ ২০ মিনিট  সিঁড়ি বেয়ে উঠলে ২৫০ ক্যালরি খরচ করতে পারে। যেটা অনেক বেশি।জিমে না গিয়েও জিমের সুবিধা পাওয়া। যা আপনার শরীরের ওজন কমাতে সাহায্য করবে। দৈনন্দিন চলাচলের কিছুটা সময় এজন্য সিঁড়ি ব্যবহার করা উচিত। তবে অবশ্যই একদিনেই ২০ মিনিট সিঁড়ি বেয়ে না উঠে। প্রথমে অল্প সময় তারপর ধীরে ধীরে সময় বাড়ানো উচিত। হার্টের রুগীরা অবশ্যই সাবধান হবেন।

খাবারের পর হালকা ব্যায়াম

খাবার পর পর যদি আধা ঘন্টা হাঁটা যায় তাহলে শরীরে দেওয়া খাবারের অতিরিক্ত টা ফ্যাট হিসেবে জমার সুযোগ পায় না। বরং ব্যবহার হয়ে যায়। অবশ্যই খোলা বাতাসের মধ্যে হাঁটা উচিত এতে ফুসফুসে বাতাসের চলাচল স্বাভাবিক থাকে। একে এরোবিক বা বাত ব্যায়াম বলে। এতে মানবদেহের ভেতরের শ্বসন ক্রিয়া স্বাভাবিক ভাবে ঘটে।

ক্যালরির চেয়ে পুষ্টিমান

ক্যালরি হিসাব করার চেয়ে পুষ্টিকর স্বাস্থ্যকর খাবার নির্বাচন করা উচিত। যেমন :- ১০০ ক্যালোরি শাকসবজি ,সালাদ,মাংস পরিমাণে বেশি হয়, দীর্ঘ সময়ের জন্য পেট ভরিয়ে রাখে তুলনামূলকভাবে ১০০ ক্যালোরির কেকের চেয়ে বেশি ভিটামিন এবং ফাইবার সরবরাহ করবে। তাই কম ক্যালরির বেশি পুষ্টিকর খাবার খেয়ে ওজন দ্রুত কমানো যায়।

উপবাস (fasting) থাকা

উপবাস থাকলে শরীরের অপ্রয়োজনীয়,অতিরিক্ত বর্জ্য বা কোষ শরীর নিজস্ব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরীর থেকে বের ফেলতে পারে। এই প্রক্রিয়াকে অটোফেজি প্রক্রিয়া বলে। উপবাসের আরেকটা সুবিধা হচ্ছে এই সময়ে শরীরে খাবার সরবরাহ না করায় শরীর তার কার্যক্রম চালানোর জন্য শরীরে জমে থাকা চর্বি ব্যবহার করে ফেলে। এর মাধ্যমে শরীরের অতিরিক্ত চর্বি শেষ হয়ে যায়। ফলে ওজন কমে যায়। তবে কাউকে একবারে দীর্ঘসময়ের উপবাসে যাওয়া উচিত নয়। ধীরে ধীরে শরীর কে অভ্যাস করে সময় ব্যবধান বাড়ানো উচিত।

ঘুম

একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের দৈনিক গড়ে - ঘন্টা ঘুমাতে হয়। অল্প ঘুমালে শরীরে কর্টিসল নামক হরমোন নির্গত করে। যা রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রন করে। যা ডায়াবেটিস হবার প্রভাবক। যথেষ্ট পরিমাণে ঘুম না হলে শরীরের হজম প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। যদি অনিদ্রা কোন রোগের কারণে হয়ে থাকে তবে সেই রোগটি সারিয়ে অনিদ্রা সমাধান করা উচিত। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে ভোরে ঘুম থেকে উঠার অভ্যেস করা দরকার। এর ফলে ওজন স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

বাইরের খাবার পরিহার

বাইরের খাবার যেমন:- চকলেট, বিস্কুট, কেক, জুস, কোমল পানীয়,পেস্ট্রি। বাইরের খাবার সব সময় পরিহার করে চলা উচিত। বাইরের খাবার মানেই অস্বাস্থ্যকর চর্বি আর চিনি। আর অস্বাস্থ্যকর চর্বি আর চিনি খেয়ে ওজন কমানোর চিন্তা করার চেয়ে বোকামি আর কিছু নেই। আম না খেয়ে প্যাকেটজাত ম্যাংগো জুস খেয়ে আমের রস খেয়েছি ভাবাটা বোকামি ছাড়া কিছু ই। বাইরের খাবারে অতিরিক্ত চিনি থাকে। চিনি মানব দেহে ক্ষুধার প্রবণতা তৈরি করে।

নিয়মিত ব্যায়াম

একজন স্বাভাবিক মানুষের সপ্তাহে ১৫০ মিনিট ব্যায়াম করা উচিত সুস্থ্য থাকার জন্য। ব্যায়াম করলে শরীরের অতিরিক্ত চর্বি কেটে যায়। ফলে শরীরের ওজন কমে যায়। কিন্তু ওজন কমানোর জন্য অতি আগ্ৰহী হয়ে অতিরিক্ত ব্যায়াম করা উচিত নয় এতে শরীরের উল্টো ক্ষতি হয়ে যায়।

ইলেকট্রনিক মিডিয়া সীমিতকরণ

মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার যতকম সম্ভব ব্যবহার করা। এগুলোর ব্যবহার জীবন থেকে সময় কেড়ে নেয়। সক্রিয়তা কমিয়ে দেয়। বেশি রাত জেগে এইসব স্ক্রিন দেখার ফলে ঘুমাতে দেরি। ঘুমের গুণগত মান কমে যায়। তাই ওজন কমাতে চাইলে অবশ্যই এইসব এর ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে আনা উচিত।

উপসংহার

ওজন বাড়ানো যতটা সহজ, কমানো ততটাই কঠিনতবে অসম্ভব নয়। এটি ধৈর্য, নিয়মিত অভ্যাস স্বাস্থ্যকর সিদ্ধান্তের ফল। আপনি যদি একটু বেশি হাঁটেন, চিনি তেল কম খান এবং ঘুম ঠিক রাখেন তবেই সম্ভব। লক্ষ্য নির্ধারণ করুন ধাপে ধাপে এগিয়ে যান। আপনি যদি নিজের উপর বিশ্বাস রাখেন, নিয়ম কানুন মেনে চলেনতাহলেই কেবল কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া সম্ভব।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url